মুরগির খাদ্যের – খামারিরা ডিম উৎপাদন করে যা মুনাফা করছে তার চেয়ে বেশি লাভ পকেটে তুলছে খুচরা বিক্রেতারা। অস্থির হয়ে ওঠা ডিমের বাজারে প্রতি ডিমে দুই টাকা পর্যন্ত লাভ করছে খুচরা বিক্রেতারা, যেখানে খামারিদের লাভ হচ্ছে সর্বোচ্চ ৫০ পয়সা থেকে এক টাকা।
খরচ পোষাতে না পেরে প্রান্তিক অনেক খামারি ডিম উৎপাদন থেকে সরে এসেছে। সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বছর বছর খাদ্যের দাম বাড়ছে। প্রতিযোগিতার বাজারে বড় খামারিরা পোষাতে পারলেও ছোট খামারিদের লোকসান দিতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুর তুলনায় মাঝামাঝিতে এসে ডিমের উৎপাদন কমে গেছে অন্তত ২৫-৩০ লাখ।
অস্থির ডিমের বাজার : বাজারসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুচরা বিক্রেতাদের বেশি মুনাফা করার প্রবণতার কারণে ভোক্তাকে বাড়তি দাম দিয়ে ডিম কিনতে হচ্ছে।
খামারি ও আড়তদারদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে প্রতিটি ডিম উৎপাদনে খামারিদের খরচ হচ্ছে ছয় থেকে সাড়ে ছয় টাকা পর্যন্ত। খামারিরা প্রতিটি ডিম বিক্রি করছে সাত টাকা পর্যন্ত দামে। আড়তদাররা পাইকারি বিক্রি করছে সর্বোচ্চ সাড়ে সাত টাকায়। খুচরা বাজারে প্রতি হালি বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৩৮ টাকা। অর্থাত্ প্রতিটি ডিমের দাম পড়ছে সাড়ে ৯ টাকা।
রামপুরার মুদি দোকানি হারুনুর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ডিমের বাজার চড়া। যে কারণে বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।’
তেজগাঁও ডিম ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি মো. হানিফ মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খুচরা বাজারে বেশি দামে বিক্রি হলে আমাদের কী করার আছে? এর জন্য মনিটর করতে হবে।’
ডিমের পাশাপাশি মাংসের মুরগি বা ব্রয়লার মুরগির দামও বেশি বলে মনে করছে অনেকেই। রাজধানীর বাজারে ১৪৫-১৫৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি, যার উৎপাদন ব্যয় ১১৫-১২০ টাকা বলে জানা গেছে।
ডিমের উৎপাদন কমছে : এ বছরের শুরুর দিকে উৎপাদন খরচ কমাতে না পারায় এবং লাভ না হওয়ার কারণে অনেকেই ডিমের উৎপাদন থেকে সরে এসেছে। এ বছরের শুরুতে এবং গত বছরের শেষ দিকে প্রতি হালি ডিমের দাম নেমে এসেছিল ২৪-২৫ টাকায়, যা উৎপাদন খরচের চেয়েও কম বলে দাবি করেন অনেকে।
জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার খামারি রাজিবুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বছরের শুরুর দিকে উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে, কখনো কখনো খরচের সমান দামে ডিম বিক্রি করতে হয়েছে। যে কারণে এখন শুধু মাংসের মুরগি পালছি।’
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) এক হিসাব বলছে, চলতি বছরের শুরুর তুলনায় মাঝামাঝিতে এসে ডিমের উৎপাদন কমে গেছে অন্তত ২৫-৩০ লাখ। আগে যেখানে প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি ৮০ লাখ ডিম উৎপাদন হতো এখন সেটা প্রায় দুই কোটি ৫০ লাখের আশপাশে নেমে এসেছে।
খাদ্যের দাম বছর বছর বাড়ছে : উৎপাদনসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডিম ও মাংসের মুরগির দাম আরো কমিয়ে আনা যেত, যদি খাদ্যের দাম কমিয়ে আনা সম্ভব হতো। প্রতিবছর যে হারে মুরগির বিভিন্ন খাদ্যের দাম বাড়ছে তাতে করে ডিমের ও মুরগির দাম বাড়াটাই স্বাভাবিক।
জানা গেছে, খামারে ব্রয়লার মুরগির খাদ্য উপাদানের মধ্যে অন্যতম সয়াবিন মিল। চাহিদার একটা অংশ পাওয়া যায় অভ্যন্তরীণ উত্স থেকে। পুরো চাহিদা মেটাতে দেশের বাইরে থেকে আমদানি করা হয় বড় একটা অংশ। গত তিন বছরে দেশি সয়াবিন মিলের দাম বেড়েছে ৩১.২৫ শতাংশ। আমদানি করা সয়াবিন মিলের দাম বেড়েছে ৪৩.২৪ শতাংশ।
মুরগির খাদ্য উপাদানের মধ্যে আরো রয়েছে ভুট্টা, রাইস পলিস, রাইস ব্র্যান অয়েল, সয়াবিন অয়েল, মিট অ্যান্ড বোনমিল বা প্রসেস প্রোটিন ও ফুল ফ্যাট সয়া।
গত তিন বছরের বাজার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রতিটি খাদ্য উপাদানের দামই উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ২০১৬ সালে ভুট্টা কিনতে খামারিদের খরচ করতে হয়েছে প্রতি কেজি ১৮ টাকা। চলতি বছরে প্রতি কেজি ভুট্টা কিনতে হচ্ছে ২০ টাকা ৫০ পয়সায়। একইভাবে দেশি সয়াবিন মিল ৩২ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪০-৪২ টাকা এবং আমদানি করা সয়াবিন মিল ৩৭-৩৮ টাকা থেকে তিন বছরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৩ টাকায়। এ ছাড়া রাইস পলিস ১৯ টাকা থেকে বেড়ে ২২ টাকা, রাইস ব্র্যান অয়েল ৭০ টাকা থেকে বেড়ে ৮৫ টাকা, সয়াবিন অয়েল ৮২ থেকে বেড়ে ৮৮ টাকা, মিট অ্যান্ড বোনমিল বা প্রসেস প্রোটিন ৩৫ টাকা থেকে বেড়ে ৫৫-৫৮ টাকা এবং ফুল ফ্যাট সয়া ৪০-৪২ টাকা থেকে বেড়ে ৪৬-৪৮ টাকা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্রয়লার মুরগির খাদ্য উপাদানের অর্ধেক স্থানীয় উত্স এবং বাকি অর্ধেক আমদানি করে চাহিদা পূরণ করা হয়। স্থানীয়ভাবে যেসব পণ্য পাওয়া যায় সেগুলোর দাম খুব একটা ওঠানামা করে না। আমদানি করে আনা পণ্যগুলোর দরদাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে ওঠানামা করে। তবে সেখানেও রয়েছে সিন্ডিকেট। আন্তর্জাতিক বাজারে যদি কোনো পণ্যের দাম ২ শতাংশ বাড়ে, তবে দেশীয় বাজারে সেটার দাম বাড়ানো হয় ২০ শতাংশ। এর প্রধান কারণ আমদানিকারকের সংখ্যা হাতে গোনা। তারা যেভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে সেভাবেই চলে।
বিপিআইসিসি ও ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের (এফআইএবি) সভাপতি মশিউর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘মুরগির খাবারের বাজারে সিন্ডিকেটের কারণে খামারিরা উৎপাদন খরচ কমাতে পারে না। যে কারণে ভোক্তারা ১৪০-১৫০ টাকার নিচে মাংস কিনতে পারছে না। তবে এটা যৌক্তিক দাম। গত ১০ বছরে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম যেভাবে বেড়েছে সেভাবে ব্রয়লার মুরগির দাম বাড়েনি। অন্যদিকে ডিমের ক্ষেত্রে খামারিরা কম দামে বিক্রি করলেও সেটার সুফল যাচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে।’
রাষ্ট্রায়ত্ত বিপণন সংস্থা টিসিবির বাজার বিশ্লেষণ অনুযায়ী, গত বছরের এই সময়েও ব্রয়লার মুরগির দাম ছিল কেজিপ্রতি ১৪০-১৫০ টাকার মধ্যে। এর আগের বছর বিক্রি হয়েছে ১৩০-১৩৫ টাকা কেজি দরে।
মুরগির খাদ্য উপাদানের দাম বাড়ার পেছনে নীতিগত কিছু সমস্যাও রয়েছে বলে জানা গেছে। সয়াবিন ওয়েল কেকের বেশির ভাগই আমদানি হয় ভারত থেকে। একটা ছোট অংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এই পণ্যটির ওপর আগে ১০ শতাংশ পর্যন্ত কাস্টমস ডিউটি ছিল। সে সময় দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক মুক্তবাণিজ্য চুক্তির (সাফটা) আওতায় ভারত থেকে বিনা শুল্কে পণ্যটি আসত। চলতি অর্থবছরের (২০১৮-১৯) বাজেটে কাস্টমস ডিউটি বাতিল করে ৫ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি আরোপ করা হয়েছে। এতে করে ভারত থেকে আমদানির ওপর ৫ শতাংশ হারে ডিউটি দিতে হচ্ছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানির ক্ষেত্রে ডিউটি কমানো হয়েছে ৫ শতাংশ। এতে খুব একটা লাভ হয়নি